যে ব্যক্তি যে নিয়ত করবে সে তার ফল পাবে


যে ব্যক্তি যে নিয়ত করবে সে তার ফল পাবেঃ
১। হুমায়দী (রহঃ) ... আলকামা ইবনু ওয়াক্কাস আল-লায়সী (রহঃ) থেকে বর্ণিত, আমি উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সেই উদ্দেশ্যেই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য। 
হাদিসের মানঃ হাদিসের মানঃ সহিহ্ বোখারী হাদিস নং ১
পুনঃনিরীক্ষণঃ 
বর্ণনাকারী রাবীঃ আলকামা ইবন ওক্কাস (রহঃ)
ব্যাখ্যাঃ-
ইমাম নববী (রহঃ) বলেনঃ নিয়ত বলতে অন্তরের সংকল্প বুঝায়। অন্তরের দৃঢ় সংকল্পই নিয়ত; কিন্তু কিরমানী বলেন, "দৃঢ়তা" নিয়তের শর্ত নয়। এটি একটি অতিরিক্ত বিশেষণ যা নিয়ত শব্দটির পূর্বে যোগ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেছেনঃ ফকীহগনের মধ্যে নিয়ত সম্পর্কে মতবিরোধ আছে। এটা কি রুকন, না শর্ত? মোটকথা এই যে, কাজের প্রারম্ভে নিয়ত করা রুকন আর কাজের মধ্যে নিয়ত করা জরুরী। নিয়তের মধ্যে শরিয়ত বিরধী কোন সংকল্প থাকতে পারবে না। এটা নিয়তের প্রধান শর্ত।

কোন কাজ করতে যাওয়ার পূর্বে নিয়ত করা অপরিহার্য। শরীয়তের পরিভাশায় আল্লাহর সন্তোষটি এবং তাঁর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্য কাজ করার সংকল্পকে নিয়ত বলা হয়। সৎকাজ করে পুণ্য লাভ করতে হলে তাঁর উদ্দেশ্যও সৎ হতে হবে। কাজের শুভ পরিনতি লাভের জন্য ভালো নিয়ত বা সৎ উদ্দেশ্য একান্ত অপরিহার্য। যথাযথ নিয়ত বা সংকল্প ব্যাতিরেকে আমল সঠিক, পরিপূর্ণ ও পুন্যবহ হতে পারে না।

হিজরত অর্থ পরিত্যাগ করা। এক বস্ত হতে অন্য বস্তুর দিকে প্রস্থান করাকে হিজরত বলা হয়। শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহ্‌ এবং তদীয় রাসুল (সাঃ) যা নিষেধ করেছে তা পরিহার করাকে হিজরত বলে। ইসলামী শরীয়তে দু'ভাবে হিজরত হতে পারে।

১) ভয়-ভীতিপূর্ণ ভূখণ্ড হতে হিজরত করে শান্তিপূর্ণ ভূখণ্ডে চলে যাওয়া। যেমনঃ ইসলামের প্রথম দিকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অনুমতিক্রমে কিছু সংখ্যক সাহাবী মক্কাবাসীদের অত্যাচারের আশঙ্কায় শান্তি ও নিরাপত্তাপূর্ণ ভূখণ্ড হাবশায় হিজরত করেছিলেন। এমনিভাবে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও আল্লাহর নির্দেশক্রমে মক্কা হতে সঙ্গী-সাথীসহ মদীনায় হিজরত করেছিলেন।

২) যে ভূখণ্ডে কাফেরদের প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে সেই ভূখণ্ডে অবস্থান করে ঈমান রক্ষা করা অসম্ভব হলে মু'মিনদের প্রভাবিত নিরাপদ ভূখণ্ডে হিজরত করে চলে যাওয়ায় একান্ত যুক্তিযুক্ত। এই জাতীয় হিজরতের অবকাশ সর্বদাই রয়েছে।

এই হাদিসটি মুহাজিরে উম্মে কায়েসের নামে মুহাদ্দিস মহলে পরিচিত। ঘটনার সারমর্ম এই যে, উম্মে কায়েস নাম্নী এক মহিলার নিকট এক ব্যাক্তি বিবাহের প্রস্তাব দিলে সে ঐ ব্যাক্তির হিজরত না করা পর্যন্ত তাঁর সাথে বিবাহে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। ফলে সেই ব্যাক্তি উম্মে কায়েসকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত করে মদীনায় আগমনপূর্বক তাঁর সাথে দাম্পত্য প্রণয় স্থাপন করে। এই লোকটিকে মুহাজিরে উম্মে কায়েস নামে অভিহিত করা হয়। ওহীর প্রারম্ভ পরবের সাথে হাদিসটির সামঞ্জস্য বিধানের ব্যাপারে হাদিসের ভাষ্যকরগন বিভিন্ন মতামত ব্যাক্ত করেছেন। তাঁর সার সংক্ষেপ নিম্নরূপঃ

প্রথমতঃ মহান আল্লাহ্‌ নবী রাসুলগনকে সাধারনভাবে এবং বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) কে বিশেষভাবে এ মর্মে অহী করেছেন যে, আমলসমূহের পারিতোষিক সহিহ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। কাজেই আমল সম্বলিত অহীর বর্ণনা প্রসঙ্গে সর্বপ্রথমে এই হাদিসটির সংকলন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে সঙ্গতভাবেই বিবেচনা করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়তঃ ইমাম বুখারী (রাহেমাহুল্লাহ) তার সহিহ হাদিস গ্রন্থের সূচনায় এই হাদিসটি সংকলন করে নিয়তের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা হতে হিজরত করে মদীনায় গমনপূর্বক খুতবা ডান প্রসঙ্গে এই হাদিস বলেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ওহী প্রাপ্তির সূচনাই ছিল হিজরত। তিনি তদীয় বাসস্থান হতে হিজরত করে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সর্বপ্রথম ওহীর সন্ধান লাভ করেছিলেন। সুতরাং ওহীর প্রারম্ভ পর্বের সাথে হিজরত সম্বলিত এই হাদিসটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
তৃতীয়তঃ কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করতে হলে নিয়তকে খালেস করা একান্ত অপরিহার্য। ইমাম বুখারী (রাহেমাহুল্লাহ) তাঁর সহীহ গন্থ সংকলনের ন্যায় একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করতে গিয়ে প্রথমে নিয়ত এবং হিজরতের গুরুত্ব সম্বলিত এই হাদিসটি সংকলন করার মাধ্যমে বরকত হাসিল করার ইচ্ছা করেছেন। অধ্যায়ের সাথে হাদিসটির সামঞ্জস্য বিধানের অনুকুলে আরও অনেক যুক্তি প্রমান পেশ করা যেতে পারে।

আলোচ্য হাদিসে মুহাদ্দিস ইমামগণের ব্যাখ্যা হতে সুস্পষ্টতঃই জানা যায় যে, নিয়ত অন্তরের ব্যাপার, মুখে উচ্চারণ করার ব্যাপার নয়। কুরআন-হাদিসের কোথাও নামায, রোজা বা যে কোন আমলের আরম্ভ করার পূর্বে কোন ভাষায় মুখে উচ্চারণপূর্বক নিয়ত করতে হবে এমন কোনই প্রমান নেই। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ী ও তাবা-তাবেয়ীদের আমলেও মুখে নিয়ত উচ্চারনের প্রমান বিদ্যমান নেই। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী বলেন, “মুখে উচ্চারণ না করার মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নতের অনুসরণ রয়েছে-“ আশে’আতুল লোম’আত। বহু গ্রন্থ প্রণেতা আশরাফ আলী থানভী (রাহেমাহুল্লাহ) লিখেছেনঃ “মুসল্লি মনে মনে নামাযের নিয়ত বা সংকল্প করবে যে, আমি যোহরের নামায পড়তেছি। তারপর আল্লাহু আকবার বলে হাত বাঁধলেই হয়ে যাবে। সমাজে প্রচলিত লম্বা-চওড়া নিয়ত পাঠের প্রয়োজনীয়তা নাই।“ (বেহেশতী জেওর ২য় খণ্ড ১৭,১৮ পৃষ্ঠা) মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রাহেমাহুল্লাহ) লিখেছেন, “অন্তরেই নামাজের মনস্থ করে নিতে হবে। অর্থাৎ মনে মনে ধারনা করবে যে, আমি ফজরের নামায পড়তেছি। মুখে নিয়ত করার কোনই প্রয়োজন নেই”। (রাহে নাজাতঃ ৯ পৃষ্ঠা)
টীকাঃ চার মাযহাবের ইমামগন একমত হয়েছেন যে, নিয়ত ব্যাতিত নামায শুদ্ধ হবে না। (কিতাবুল ফিকহে “আলাল মাযাহিবিল আরবাআহঃ ১ম খণ্ড ২১০ পৃষ্ঠা)

No comments

Powered by Blogger.